এক
পাবনা পুলিশ লাইন পার হয়ে পুরানো ব্রিজ । ব্রিজ পেরিয়ে কিছুদূর গেলে হাতের বামে সিভিল সার্জনের কোয়াটার । সেটার গা ঘেঁসে চিলতে একটা অনেকখানি লম্বা গলি পথ , রাস্তাও বলা চলে ভদ্রভাবে । তবে লোকে বলে সালাম মিয়ার গলি । সালাম মিয়া কিছুদিন আগেও পাবনা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন । জনদরদী হিসাবে তার বেশ খ্যাতিও আছে । এই মানুষটিকে ভালবেসে তাঁর বাড়ীতে ঢোকার এ পথটাকে লোকে সালাম মিয়ার গলি বলে ।
এ গল্পের কাহিনী যখন চলমান , তখন সালাম মিয়া বেঁচে । তিন ভাই মিলে এ জেলায় সে জেলায় চুটিয়ে বালু , মাটি আর পাথরের সাপ্লাই ব্যবসা করে বেড়াচ্ছেন ।
তা যা হোক সালাম মিয়ার বাড়ী পেরিয়ে সাদা রঙের মসজিদটা পার হয়ে হাতের ডান দিকে বেশ একটু খোলামেলা খালি জমি । তার একপাশে তিন চারটে গাড়ী রাখার গ্যারেজ । চারপাশে ইটের গাঁথুনি উপরে টিনের চালা দিয়ে তৈরি। গাড়ী বের করার সুবিধার্থে গ্যারেজের সামনের দিকটা একটু পাকা করা । চেয়ারম্যান সাহেবের লাল জিপটা আর তিন খানা ট্রাক রাখা হয় গ্যারেজে ।
গাড়ী আর গ্যারেজের তদারকির জন্য সালাম সাহেব সদ্য একজন লোককে নিয়োজিত করেছেন । অবশ্য নিয়োজিত না বলে বলা যায় , লোকটি নিজেই বলে কয়ে নিজেকে সালাম সাহেবের কাজে লাগিয়েছে । তাঁকে আর তার বিবিকে বিনে পয়সায় খাওয়া দাওয়া করান সালাম সাহেব অনেক অনেক কাল ধরে । মিছেমিছি বসে বসে একজন মানুষের অন্ন ধ্বংস করা হারাম । তাই অনেক ভেবে চিন্তে রমজান আলী সালাম সাহেবের সামনে নতজানু হয়ে কাচুমাচু আর বিনীত ভঙ্গিতে চাকুরীর বিষয়টা উপস্থাপন করেছিল সেদিন ।
সালাম সাহেব তখন উঠোনে পাতা মস্ত গোল টেবিলটার চেয়ারে বসে রকমারি নাস্তা সারছিলেন আর মাঝেমধ্যে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন । পাশে তার দুই ভাই জয়নাল মিয়া আর জামান মিয়া বসে। তারাও প্রাতঃরাশ সারছে । একটু দূরে বারান্দার উপর মাঝারি উঁচু একটা জলচৌকিতে বসে জোবেদা খাতুন , তিন ছেলের খাবার দাবারের তদারকি করছেন । অন্দরমহলে তিন ছেলে বউ তাঁদের কাচ্চাবাচ্চার নাওয়া খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত ।
সালাম মিয়া খবরের কাগজ থেকে একটু মুখ তুলে রমজান আলীর দিকে তাকালেন । হাঁটুর উপর ডোরা চেক কাটা লুঙ্গি আর একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে লোকটা এই মাঘ মাসের শীতে হু হু করে কাঁপছে ।
কি চাও রমজান আলী , এত সাঁঝ সকালে ? সালাম মিয়া তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন ।
কিছু না হুজুর , কিছুই না । আপনি দেওয়ার আর কিছু কি কমতি রাখচেন ? রমজান মাথা নিচু করেই উত্তর দেয় ।
হু , তা বটে । কিন্তু গেলবারে যে উলের মোটা চাদরটা দিলাম , সেটার কি করল্যা মিয়া ? হারায় ফেল্লা না তুমার বউ সেটারে কুটি কুটি করে চুলায় দিলো?
রমজান আলী মাথা নাড়ে বারে বারে। তার মানে হ্যাঁ । হুজুরের কাছে মিথ্যা বলার মানে হয় না । কুটি তাঁর বউ , তার উপর রাগ করে গত পরশু দিন সেটারে চুলায় দিছে । এতো জারের ভেতর রমজান আলীর কাঁপাকাঁপি দেখে হুজুর সে রকম একটা কিছু ঠিকঠিকই আঁচ কোরতে পেরেছে !
তুমাকে না ঘরে চুলা জ্বালাতে নিষেধ করা হইছে বার বার। যার জন্য মা তুমার আর তুমার বউয়ের জন্য রোজ তিনবেলা খাওয়ার পাঠায় । তারপরও তুমার পাগলী বউ চুলা জ্বালায় । সে ম্যাচ কুথায় পায় । তুমি বিড়ি খাও নাকি মিয়া , সালাম মিয়া বেশ গুরুগম্ভীর স্বরেই রমজান আলীকে জিজ্ঞেস করে !
রমজান আলী আমতা আমতা করে । তাঁর ঝুরঝুরে টুকরো মুখটা ভয়ে ঠাণ্ডায় আরও ছোট দেখায় । দমকা শীতের বাতাসে চুপসে যায় তাঁর লম্বা সাদা দাড়ী । নীচু হওয়া বামন শরীরটা আরও ছোট আর পাংশুটে দেখায় ।
সালাম মিয়ার মা জোবেদা খাতু্ন ততক্ষণে একটা কালো রঙের ভারী কম্বল কাজের মেয়েটাকে দিয়ে রমজান আলীর গায়ে চড়িয়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আর দূর থেকেই ঘড়ঘড় করে রমজানকে বারে বারে সাবধান করে দিয়ে বলছিলেন- রমজান এই শেষ । পাগলিটাকে অত মাথায় তুল না । একটু গালমন্দ কোর । না হোলে কোনদিন দেখব্যা সেই তুমারে চুলায় দিছে ।
বড় মার কথা মিথ্যা নয় । দিনকে দিন কুটিটার পাগলামি যেন জোয়ারের পানির মতো তরতর কোরে বেড়েই চলছে । সামাল দেয়া যায় না । যদিও শীতকালে তা একটু কম ! তারপরও !
ও একটা চাকরি চায় মিয়া ভাই্ট। এদ্দিন বাদে তার একটা চাকরি করার সাধ হইছে- টেবিলের ও পাশ থেকে জামান মিয়া খকখকিয়ে হেসে হেসে বলতে থাকে । তাহলেই হইছে , এবার গ্যারেজগুরেজ না পুড়লে ত আর শান্তি নাই , জয়নাল মিয়াও সেই সাথে টিপুন্নি কাটে ।
ত লও চাকরি দিলাম মিয়া । গ্যারেজের কাম । কিন্তু তার আগে তোমার বউরে ঠিক করো । দরকার পড়লে আবার তারে মেন্টালে দেখাও । তারপর মাথা ঠাণ্ডা করে চাকরি করো - রমজানের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে সালাম মিয়া তাঁর প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করে বৈঠকখানার দিকে পা বাড়ান !সেখানে অনেক মানুষ বসে আছে তাঁর একটু দয়ার প্রত্যাশায় । রমজানের কথা আলাদা । চেয়ারম্যান বাড়ীর অন্দরমহলে ঢোকার তার যথেচ্ছ অধিকার আছে বটে !
দুই
চারপাশটায় ছোট বড় খাবড়া খাবড়া ইট আর সিমেন্ট বালিমাটি দিয়ে গাঁথা উপরে কালো টিনের ছাউনী পাতা যে ছোট্ট ঘরটাতে রমজান আর কুটি বাস করে তা সালাম মিয়ারই দান। তিনিই থাকতে দিয়েছেন এখানে ওদেরকে অনেককাল আগে থেকে । কিন্তু কতকাল আগে , তা অবশ্য তেমন কোরে আজ জানে নাও কেউ । আর জানার প্রয়োজনও বোধ করে না ।
ছোট্ট ঘরটার সামনের দিকটায় একটা চওড়া ইন্দারা । প্রায় এক মানুষ সমান কোরে উঁচু কোরে ইট সিমেন্ট প্লাস্টারে বাঁধানো । ইন্দারার চারপাশটায় গোল করে অনেকখানি যায়গা পাকা করা । ইন্দারাটায় মাথায় কপিকল , মোটা দড়িতে বাঁধা পেটমোটা গাতুগুটু টিনের একটা বালতি , বহু ব্যবহারে তা ট্যাপ খাওয়ানো । পাড়ার গরীব-গরবার বউঝিরা হরদম পানি নিয়ে যায় ইন্দারা থেকে । পানি তোলা শেষ হোলে , কলসি ঘড়া কাখে নিয়ে একবার করে চুপিসারে রমজানের ঘরে উঁকি মারে । কি করে রমজান মিয়া আর তাঁর বউ কুটি , কুটি পাগলী – তা জানতে আগ্রহ নিত্য আগ্রহ পাড়ার বউ ঝি ছেলে বুড়ো সবার ।
একটা ছোট্ট চৌকি , তাতে ময়লা সবুজ রঙের কুঁচকানো একটা ভারী কম্বল বিছানো । সেখানে কে একজন মাথায় লম্বা কাপড় মুড়ে উল্টো দিকে মুখ কোরে ঘুরে বসা । কুটি পাগলী , কুটি পাগলী – আস্তে আস্তে বউ ঝিরা এ ওর গা ঠেলাঠেলি করে । কুটি পাগলী ! তাই তো । কিন্তু মুখটা তো দেখতে পারলাম না । কেমুন বা দেখতে ? ভাবতে ভাবতেই ঘরের মধ্যে থেকে হুঙ্কার শোনা যায় – কুন হারামজাদিরে ----? নিজের ভাতারেক জায়া দ্যাখ । বউ ঝিরা পাল্লাপাল্লি করে দৌড় লাগায় । যদি ইটা মারে পাগলিটা , এই ভয়ে । পাড়ার অনেকের মাথায় পেছন থেকে বসে বসেই ইট মেরে জখম করে দিয়েছে পাগলীটা ।পাগলী না ছাই । হাতের অত তাক পায় কোথায় । ভূত না জীন নাকি !
কুটিকে নিয়ে হাজার রকম কথা ঘুরে বেড়ায় পাড়াময় । নানাজন সত্য মিথ্যা নানা কথা বলে বেড়ায় ! নানা রহস্যে ঘেরা সেসব কথা আর রচনা রটনা ।
রমজানকে আশে পাশে দেখা যায় না । হয়তো গ্যারেজের কাজ করছে । কাজ আর কি ? কাজ বলতে গ্যারেজগুলোর ভেতরে ঝাড়ু দেয়া , সামনের চিলতে উঠানটায় ঝাড় ঝাটা দিয়ে ময়লাগুলো এককোণে জমা করা । কাছাকাছি থাকলে ঘরে তালা লাগায় না রমজান। একটু দুরে গেলে চিলতে একটা তালা লাগায় দরজায়। তারপরও ভয় , পাড়ার মহা শয়তান ছেলেপেলেদের দিয়ে । কি যে সুখ পায় ওরা পাগলী দেখে । আগের সেই রুপ কি আর আছে কুটির শরীরে ? সুন্দর সাদা মুখটা শুঁকায় সেই কোনকাল থেকেই তো আমসি । না খেয়ে খেয়ে শরীর হাড্ডি সার । ভালো কোরে গায়ে কাপড় চড়াতেও পারে না সে । তারপরও কুটিকে দেখার জন্য হাড্ডাহাড্ডি পাল্লাপাল্লি ।
কাজ শেষ না করেই রমজান এখুনি আগে ঘরে ফিরতে মনস্থির করে । এখান থেকেও এখনও কুটির চিৎকার শোনা যাচ্ছে । আজও কেউ নিশ্চয়ই টোকা দিছে পাগলীটারে । টোকা না দিলে তো কুটির এত ক্ষ্যাপার কথা না ।
তিন
কুটিরে তুই কেন খ্যাপিস , খ্যাপিস তো খ্যাপিস ইটা মাইরা এর অর মাথা জখম কইরা দিস কান? তরে নিয়া আবার নালিশ বসব , আমার এত নালিস ভালা লাগে না রে কুটি । ইচ্ছা হয় মইরা বাঁচি । রাগ হলেই প্যাঁচাল পারতে থাকে রমজান ।
স্বামীর এতো কথার কি বোঝে কুটি তা আল্লা মালুম। কেবল শেষ কথাটা রমজান আলী তাঁর মুখ থেকে ফেলবার আগেই কোথা থেকে যেন ঈগল পাখীর মতো ছোঁ দিয়ে এসে পড়ে স্বামীর মুখটা দুর্বল দুহাতে চাপ দিয়ে ধরে ফেলে সে ।
ওহ , তাহলে তুই আমার সব কথা বুঝিস কুটি , এই মইরা যাবার কথা ?
ওপাশ থেকে কুটকুট কোরে হেসে মাথা নাড়ে কুটি , তারমানে সে বোঝে । সে বোঝে রমজান আলী মরে গেলে তাঁকে কেইবা দেখবে। কেইবা যত্ন করে মুখে তুলে খাওয়াবে , কেইবা পেঁচিয়ে কুঁচিয়ে কাপড় পড়িয়ে দেবে আর পাড়ার শয়তান ছ্যামড়া – ছেমরিগুলোর হাত থেকে বাঁচাবে তাঁকে।
ওহ , তার মানে তুই নিজের জন্য আমারে চাস । স্বার্থে । আমারে
ভালোবাসিস না তুই । ভালোবাসিস সেই গোঁয়ার শয়তান মহব্বত খাঁ রে !
মাথা নাড়ায় কুটি । তার মানে হাঁ না না তার কোনটাই স্পষ্ট হয়না রমজান আলীর কাছে । এতকাল একসাথে থেকে কুটির অনেক কথার মর্মই বুঝতে পারে বটে রমজান । কিন্তু এই মহব্বত খাঁরে নিয়া কুটিরে প্রশ্ন করলে তার জুতসই একটা জবাব আজও বোধহয় দিতে পারে না কুটি । পারে কি পারে না তা আল্লাহ মালুম , কিন্তু রমজানের কাছে মনে হয় কুটি আজও সেই শয়তানটারে ভালবাসে । তাই তারে বকামন্দ করলে সে চুপ করে থাকে !
যেদিন যেদিন মহব্বত খাঁর কথা ওঠে সেদিন সেদিন রাগে লাল আগুনের মতো গনগনে মুখ কোরে রাখে কুটি । রমজানও কম যায় না । কাজকাম শিকায় তুলে মুখটা পাকা কমলার মতো ফুলিয়ে ঘরের বিছানা জুড়ে পরে থাকে সে । এমনকি , সালাম মিয়া ডাক পাঠালেও সাড়া দেয় না ।
দিবেই বা ক্যান রমজান আলী । এই সালাম মিয়াই তো তাঁর জীবন নাটের গুরু । বেশতো ছিল বাপ মা মরা রমজান আলী সালাম মিয়ার দেশের বাড়ীর জমি জমা চাষ করে । তাগড়া ইয়া জোয়ান কিন্তু ঘাড়ে খাটো , মানে যাকে বলে লম্বায় কম। পরিশ্রমী আর বিনয়ী রমজান আলীর যেমন সুনাম ছিল গ্রাম জুড়ে , তেমনি সালাম মিয়ার পরিবারের লোকজনও তাঁকে খুব ভালোবাসতো , বিশেষতঃ সালাম মিয়ার মা জোবেদা খাতুন ।
এরই মধ্যে ঘটলো কাঞ্চনমালার ঘটনা । কাঞ্চনমালা ওরফে কুটি সালাম মিয়ার আপন চাচাতো বোন । বিয়ের তিন বছর যেতে না যেতেই মহব্বত খাঁ নামের লোকটা কাঞ্চনমালাকে তালাক দিয়েছিল । কাঞ্চনমালার দোষ সে বিয়ের তিন তিনটে বছরের মাথায়ও স্বামীকে একটা সন্তান দিতে পারেনি । এক কাপড়ে সেই যে কাঞ্চনমালা বাপের ঘরে ফিরে এসেছিল , সেই থেকে পাড়ার কাক পক্ষীও তাঁর মুখ দেখতে পারেনি । আপন ঘরেই আপনাতেই নির্বাসন নিয়েছিল সে ! কারো সাথে যেচে পরে কথা কইতো না । কি খেত , কি পড়তো তা খোদাই জানেন ।
এহেন কাঞ্চনমালাকে নিয়ে তাঁর হতদরিদ্র বাপমার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না । দিনকে দিন এক রকম পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করেছিল সে । এ হেন কাঞ্চনমালাকে দেখেশুনে ঠিক রাখার জন্য নিরক্ষর রমজান আলীর হাতেই তাঁকে সমর্পণ করা ঠিক বলে মনে করলো কাঞ্চনমালার পরিবার । আর এ কাজে গরীব চাচা-চাচিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলো আমাদের দরাজদিল সালাম মিয়া । ইয়াসিন মিয়ার ভাতিজা সালাম মিয়ার তখন রমরমা অবস্থা । পৌরসভার চেয়ারম্যান । সাথে নানা ধরণের ব্যবসা । কুটি আর রমজান আলীর মতো দুইচার দশজন মানুষের দায়িত্ব নেয়া তাঁর মতো মানুষের জন্য কিছুই না ।
সেই যে সালাম মিয়া একরাতের মধ্যে কুটিকে রমজান আলীর সাথে বিয়ে দিয়ে নিয়ে আসলো শহরে নিজেদের বাড়ীতে , সে থেকেই কুটি আর রমজানের দেখাশোনার অলিখিত দায়িত্ব সালাম মিয়ার পরিবারের উপরই বর্তালো । ওদেরকে কোনদিন অ্সন্মান করেনি বটে এই পরিবার । মস্ত এ বাড়ীটার এক কোনার ঘরে এখনকার মতই বছরের পর বছর ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকতো কুটি । রমজান এখনকার মতোই মন দিয়ে আধা-পাগলী বউটার দেখাশুনা করতো । তবে ধীরে ধীরে সালাম মিয়ারা তিন ভাই বিয়ে করলে আর ওদের কাচ্চা বাচ্চারা সব বড় হতে শুরু করলে , কুটি আর রমজানের জন্য গ্যারেজের পাশে ঘরটা তুলে দেয়া হয়েছে – জোবেদা খাতুনের পরামর্শে ।
মহব্বত খাঁর কথা নিয়ে কুটির সাথে মন- কষাকষি হোলেই সালাম মিয়াকে মনে মনে গাল পারে রমজান মিয়া । সেই তো জীবনটা তাঁর নষ্ট করে দিলো । কুটিকে বিয়ে করে কিইবা পেল সে। অন্য কিছু নয় , রমজান আলী কেবল ভালবাসা চেয়েছিলো যৌবনে তাঁর সুন্দরী বউটার কাছ থেকে । আজও যেমনি চায় । কিন্ত কুটি কি তা বুঝে ? বুঝে না , বুঝে না সে ! না হলে সে কি মহব্বত খাঁর কথা উঠলেই ওরকম আগুন মুখো হয়ে থাকতো ।
চার
তারপরও কুটিকে খুব ভালবাসে রমজান ।পাগলের সাথে মাথা খারাপ করে থাকা কি ভালো মানুষের চলে । আহা , কি বা বোঝে পাগলীটা আমার- রমজান সস্নেহে মনে মনে বলে চলে ।
তারপর নিজের বাড়তি রাগটা ঝেড়ে ফেলে ন্যাতানো বিছানাটার উপর উঠে বসে । বলে- আমার পাগলী , স্বামীর উপর এতো গোসা করে মানুষ থাকে নাকি! আয় এদিকে ।
কাঞ্চনমালা ওরফে কুটি ধীরে ধীরে স্বামীর দিকে এগিয়ে আসে , কাছে বসে।
রমজান জলন্ত চুলোর আগুনে নারকেল তেলের কৌটাটা খানিকক্ষণ বসিয়ে রেখে তা গলে গেলে , কৌটা থেকে একটা মাটির পাত্রে তেল ঢেলে নিয়ে তা ধীরে ধীরে কাঞ্চনমালা ওরফে কুটির মাথায় বিলি করে বসিয়ে দেয় । কুটি রানীর মতো স্বামীর গায়ে হেলান দিয়ে বসে আর মাঝে মধ্যে আহা উহু করে । তেল মাথায় দেয়ার সময় এটা সে করবেই । তেল দেয়া শেষ হলে রমজান ধীরে ধীরে মোটা দাঁতের চিরুনীটা দিয়ে বউয়ের মাথা আচড়িয়ে দেয় । তারপর অভ্যস্ত হাতে শক্ত কোরে একটা বেনুনী গাঁথে । এরপর হাতটা ধুয়ে নিয়ে কুটির মুখে একগাল দুগাল করে তরকারী মাখানো ভাত তুলে দেয় ।
বউয়ের খাওয়া শেষ হলে রমজান আলী খেতে বসে , ততক্ষণে মহব্বত খাঁকে নিয়ে কুটির উপর জিইয়ে রাখা রাগটা তাঁর পানি হয়ে গেছে !
পাঁচ
সালাম মিয়ার কাছ থেকে রমজান আলী সেদিন জেনেছে বটে মহব্বত খাঁ নাকি এ পাড়ায় কাজে এসেছে । আগে রাজমিস্ত্রির যোগানদার ছিল সে , এখন নিজেই বড়সর রাজমিস্ত্রি। বড় বড় বাড়ী ঘর তোলার কাজ করে চুক্তি কোরে । ম্যালা কামাই । বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে তাঁর ভরা সংসার !
সালাম মিয়া বারে বারে সাবধান করে দিয়েছে রমজানকে কুটিকে সাবধানে
সামলিয়ে রাখতে । বলা তো যায় না , মাথা পাগল মানুষ কোথা থেকে কি করে ফেলে ।
রমজান আলী যদিও ঘন ঘন মাথা নাড়িয়েছে , তবুও তাঁর মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তা । কিসে থেকে কি হয় ।মহব্বত খাঁর মত মন্দ মানুষকে বিশ্বাস করা যায় না ।
কুটিকে বলি বলি করেও বলা হয়নি তাঁর আগের স্বামী , তাঁর প্রথম স্বামী মহব্বত খাঁর কথা । যাকে বোধহয় এখনও ভালবাসে কাঞ্চনমালা ওরফে কুটি। যার কথা ভেবে ভেবে আজতক পাগল হয়ে আছে সে । তাইতো জীবনের প্রথম ভালবাসাকে কি মানুষ ভুলতে পারে । কুটির কি দোষ , তাঁর প্রথম প্রেমের মানুষটাকে ভুলেও ভুলতে পারেনি সে । রমজান আলী নিজে হলে কি করতো ? কুটিকে সে কি কোনদিন ভুলতে পেরেছে বা পারবে ? এই যে পদে পদে কষ্ট , যন্ত্রণা – তারপরও কুটি রমজান আলীর প্রান , জীবন । তারপরও রমজান আলীর মনে হয় , কুটি বোধ হয় তাঁকে তেমন কোরে ভালবাসে না , যেমন কোরে সে ভালবাসে বা বাসতো মহব্বত খাঁকে ।
সেদিন কি মনে করে ঘরের দরজায় তালা লাগাতে ভুলে গিয়েছিলো রমজান আলী । সালাম মিয়া একটা কি কাজের জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁকে । তাড়া ছিল । সত্যি কোরে তালা লাগাতে ভুলে গিয়েছিলো রমজান আলী ! তড়ি ঘড়ি করে ঘরে ফিরতেই দ্যাখে দরজার কপাট হা করে খোলা ।
কে , কে ওখানে – লোকটাকে এত বছর বাদেও চিনতে ভুল করলো না রমজান আলী । মহব্বত খাঁ । সে ক্যান এখানে ? কাঞ্চনমালাকে দেখতে এসেছে ? তাঁর কুটিকে ? কিন্তু কুটি ? সে কি করছে । ভালোবাসার পুরানো মানুষকে দেখে সেকি তার অতীতের রাগ ক্রোধ পাগলামী সব –সব ভুলে গ্যাছে ?
কিন্তু একি ? কুটির হাতে চকির তলে লুকিয়ে রাখা সেই ধারালো রামদাটা । সেটা সে বের করলো কি করে ?
মহব্বত খাঁ রমজান আলীকে দেখতে পেয়ে ধরে প্রাণ ফিরে পেল যেন । কোনদিক না তাকিয়ে সেই যে জীবনবাচন দৌড় লাগালো সে – রমজান আলী ঘুরে ফিরে তার টিকিটিও আর দেখতে পেল না ।
কাঞ্চনমালা ওরফে কুটি হাসছে , সেই পুরানো দিনের খিলখিল হাসি , যে হাসিকে অনেকদিন তাঁর নিজের জন্য নয় বলে ভুল বুঝেছিলো রমজান আলী ! এদ্দিন বাদে সত্যি সত্যি যেন বুঝতে পেরে গ্যাছে রমজান আলী- কুটি তাঁর নিজের , কেবলি তাঁর নিজের ! কুটি তাঁর বউ , একেবারে নিজের বউ ।